একদা সামাজিক মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ফেসবুক আজকে কিছু মানুষের অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ভিডিওতে ভিউ হলে রেভিনিউ ইনকাম আর পোস্ট ভাইরাল হলে প্রচুর ফলোয়ার, বলাই বাহুল্য ভাইরাল হওয়ার এই চক্করে আজ ফেক ভিডিও, ফেক ছবি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জেনারেটেড কনটেন্ট তথা ডিপ ফেক ভিডিও তৈরিতে হাত পাকাচ্ছে কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী। জনগণের আবেগকে উস্কে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! আমরা গত কয়েক বছরে এর অগণিত প্রমাণ পেয়েছি । খুব সাম্প্রতিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজ মাধ্যমে যে কদর্য প্রচার চলছে তা দেখে সংবেদনশীল সচেতন মানুষ হয়তো আগামীতে পথে ঘাটে বিপদগ্রস্ত অপরিচিত সহ নাগরিকের প্রতি সাহায্যের, সমবেদনার হাত বাড়িয়ে দিতে ভয় পাবেন।
গত 22 শে সেপ্টেম্বর কৃষ্ণনগর থেকে শিয়ালদা গামী ট্রেনে উঠেছিলেন নদীয়ার গোবরাপোতা নেতাজি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার বিশ্বাস। কিন্তু কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পরপরই প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই প্রবীণ ব্যক্তি এবং পরবর্তীতে তাহেরপুর স্টেশন থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় নদীয়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসে তার পরিবার। এর পরই সমাজ মাধ্যমে তাহেরপুর স্টেশনে একটি রেলিংয়ের গায়ে অচেতন অবস্থায় মাথা এলিয়ে থাকা প্রদীপ বাবুর একটি ছবি ভাইরাল হতে থাকে। যেখানে দাবি করা হয় অসুস্থ প্রদীপবাবু কে তাহেরপুর রেল প্লাটফর্মে নামিয়ে রেখে চলে যান তার সহযাত্রীরা, যেখানে দীর্ঘক্ষণ অচৈতন্য অবস্থায় পরে থাকার পর তার মৃত্যু ঘটে। এমনকি এই ভাইরাল পোস্টের সত্যতা যাচাই না করেই স্বস্তিকা মুখার্জির মত জনপ্রিয় অভিনেত্রীও ফেসবুক এ তার অফিশিয়াল পেজে এই ছবি পোস্ট করে বলেন -
"ইনি গোবরাপোতা নেতাজি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার বিশ্বাস । রবিবার ট্রেনে কলকাতা যাওয়ার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সহযাত্রীরা তাহেরপুর স্টেশনের এই জায়গায় নামিয়ে দেন। এইভাবেই তিনি দীর্ঘ সময় পড়ে থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।"
গত কয়েকদিন ধরে এই পোস্ট ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই আমাদের নজরে আসে বিষয়টি এবং আমরা তখন চেষ্টা করতে থাকি ঘটনার দিন ওই কামরায় মৃত প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের কোন সহযাত্রীর সাথে যোগাযোগ করার । ওই দিন প্রদীপ বাবুর সাথে একই কামরায় ছিলেন সহযাত্রী অরূপ সরকার, তিনিও পেশায় একজন শিক্ষক। তার কাছ থেকেই আমরা ওইদিনের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাই।
অরূপ বাবু জানান- কৃষ্ণনগর রেলস্টেশন থেকে সকাল 9 টার শিয়ালদা গামী ট্রেনে উঠেছিলেন তিনি। তার কন্যাকে নিয়ে তিনি কলকাতায় যাচ্ছিলেন ডাক্তার দেখাতে। গাড়ি কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর হঠাৎ পেছনে শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে অরূপ বাবু দেখেন একজন ব্যক্তি ট্রেনের মধ্যেই পড়ে গিয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন। অন্যান্য সহযাত্রীদের মত অরূপ বাবুও এগিয়ে যান অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া ওই ব্যক্তি অর্থাৎ প্রদীপ বাবুর কাছে এবং গিয়ে দেখেন তিনি অচেতন হয়ে পড়েছেন। ঘটনার সাথেসাথেই প্রদীপ বাবুর সহযাত্রীরা তৎপরতার সাথে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। চোখেমুখে জল দেওয়ার পরও যখন জ্ঞান ফেরে না তখন তার বুকে পাম্প করতে থাকেন অরূপ বাবু। তার ভাষায় " এরপর নিঃশ্বাস চালু হলেও মনে হচ্ছিল উনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, অনেকটা কোমার মত অবস্থা"। অরূপ বাবু অসুস্থ প্রদীপ বিশ্বাসের ব্যাগ খুঁজে কিছু ওষুধ দেখতে পান যার কোনোটিই জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য ছিলনা তখন দিশেহারা হয়ে ওই কামরার যাত্রীরা গার্ডের সাথে যোগাযোগ করেন, রেলের গার্ড বলেন বাদকুল্লায় তেমন কোন সুব্যবস্থা নেই তাই তাহেরপুর নামালে, তাহেরপুর থানা কে তারা জানিয়ে দেবে, তারাই যথাযথ ব্যবস্থা করবে। এরপর ওই কামরার চারজন যাত্রী প্রদীপ বাবুর অচেতন দেহ নিয়ে তাহেরপুর স্টেশনে নেমে যান। তবে ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর উনি পরে জানতে পারেন অরূপ বাবু এবং তারপরই প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন । উনার পরিবার জানায় - প্রদীপ বাবুর মোবাইল ফোনটি যে যাত্রীরা তাকে তাহেরপুর স্টেশনে নামিয়ে ছিলেন তারাই স্টেশন মাস্টারের হাতে জমা দিয়ে যান, সেখান থেকেই তাঁর হদিস পায় পরিবার। অরুপ বাবুর মতে " হয়তো সাহায্যকারী যাত্রীরা তার হঠাৎ মৃত্যুতে ভয় পেয়ে উনার দেহ প্লাটফর্মে রেখে বিষয়টি স্টেশন মাস্টার কে জানাতে গেছিলেন।" তবে তারা তাকে যে ফেলে রেখে যাননি তার প্রমাণ বহন করে ওই মোবাইলটি, যা দায়িত্বের সাথে স্টেশন মাস্টারের হাতে জমা দিয়েছিলেন ওই যাত্রীরা। এর পর প্রত্যক্ষ দর্শীদের কাছে জানা যায় যে সেদিন ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেন ধরেন প্রদীপবাবু, হতে পারে প্রবীণ ঐ ব্যক্তি সে কারনেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
প্রসঙ্গত ফেসবুকে যে ছবিটি ভাইরাল হচ্ছে অথবা ভাইরাল করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা একটি ক্রপ করা ছবি বলেই আমাদের অনুমান, কারণ সম্ভাব্য মোবাইল ফোনে তোলা এই ছবিটি পোট্রেট বা ল্যান্ডস্কেপ কোন সাইজের ই নয়। হয়ত প্রদীপ বাবুর পাশে আরো কিছু মানুষ ছিলেন যাদেরকে ছবি থেকে ক্রপ করে বাদ দেওয়া হয়। ছবিটি যদি লং শট ছবি হতো তাহলে বোঝা যেত ছবিটিতে প্রদীপ বাবুর পাশে সত্যিই কেউ ছিল নাকি বেলা নটার সময় প্লাটফর্মে একা অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন প্রদীপ বাবু।
সর্বোপরি আমরা বলতে চাই পশ্চিমবাংলার মানুষ আজও এতটা হৃদয়হীন হয়ে যায়নি যে পথ চলতি অসুস্থ মানুষকে পথেই ফেলে রেখে চলে যাবে। একবার ভেবে দেখুন সহৃদয় সেইসব মানুষ যারা আজও বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান- তাদের সেই মহত্বকে কালিমা লিপ্ত করে এভাবে যদি গুজব রটানো হয় তাহলে আগামীতে বিপন্ন মানুষের পাশে আরো একবার দাঁড়াবেন তো?! তাই গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না, মানবতায় বিশ্বাস রাখুন!